একের পর এক ধর্ষণ, লুঠ, অগ্নিসংযোগ, খুন; স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ, মণিপুরের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবী ইরম শর্মিলার
ব্রেকিং বাংলা ন্যাশনাল ডেস্ক, ২৩ জুলাই: গত ৩ মে থেকেই গোষ্ঠী সংঘর্ষে উত্তাল উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্য। এরই মধ্যে গত বুধবার একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে প্রকাশ্যে ঘোরানোর ছবি সামনে আসার পর থেকেই নতুন করে উত্তাল হয়ে ওঠে মণিপুর। গত ৪ মে ওই ঘটনা ঘটলেও তা সামনে আসে প্রায় আড়াই মাস পর। মহিলাদের ওপর নির্যাতনের সেই ছবি দেখে শিউরে ওঠে গোটা দেশবাসী।
সেই আবহেই আরও এক অকল্পনীয় নৃশংসতার খবর উঠে এল মণিপুর থেকে। প্রয়াত এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠল। ঘরের ভিতর ওই বৃদ্ধাকে তালা বন্ধ করে রেখে বাইরে থেকে অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
নৃশংস এই ঘটনাটি ঘটে মণিপুরের কাকচিং জেলার সেরাউ গ্রামে। ৮০ বছর বয়সী ওই বৃদ্ধা বিনোদেবীর স্বামী ছিলেন প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী এস চূড়াচাঁদ সিং। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের হাতে সম্মানিত হয়েছিলেন ওই স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁরই পরিবারের সাথে এমন একটি ঘটনায় হতবাক সকলেই।
জানা গেছে গত ২৮ মে ওই ঘটনাটি ঘটে। সিরোগ্রামের চারপাশে তখন বোমা গুলির লড়াই, একাধিক বাড়িতে অগ্নি সংযোগের ঘটনাও ঘটে। তারই মধ্যে একদল অস্ত্রধারী দুষ্কৃতী বিনোদেবীর বাড়িতে চড়াও হয়। তারা প্রথমে বাইরে থেকে ঘরের তালা লাগিয়ে দেয় এরপরই অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়। পাশাপাশি গুলিও চালানো হয় বলে অভিযোগ। এ সময় তার ঠাকুরমাকে উদ্ধার করতে গিয়ে গুলিতে আহত হন বিনোদেবীর নাতি প্রেমকান্ত। গুলি তার হাত ছুঁয়ে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়, গুলি লাগে তার কোমরেও। পরে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে বাঁচেন প্রেমকান্ত। পরে যখন তিনি ঘটনাস্থলে আসেন তখন পোড়া জিনিস আর ওই বৃদ্ধার মাথার খুলি ছাড়া কিছুই খুঁজে পাননি। আর ছিল একই ফ্রেমে বাঁধা তার ঠাকুরদাদা এস চূড়াচাঁদ সিং'এর সাথে এপিজে আব্দুল কালামের একটি ছবি।
শুধু তাই নয় গত ৪ মে- যেদিন দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে ঘোরানো হয় বলে অভিযোগ, সেই দিনই কাংপোকপি জেলায় জনজাতি সম্প্রদায়ের আরও দুই তরুণীকে ধর্ষণের পর তাদের খুন করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ২১ ও ২৪ বছর বয়সী ওই দুই তরুণী কোনুং মামাংয়ে গাড়ি পরিষ্কারের কাজ করতেন। গত ৪ মে তাদের ওপর চড়াও হয় একদল দুষ্কৃতী। পরে দুই তরুণীকে জোরপূর্বক ধরে একটি ঘরের মধ্যে ঢোকানো হয় এবং তারপর মুখে কাপড় গুঁজে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে পাশবিক অত্যাচার চালানো হয়। পরে রক্তাক্ত ও অর্ধ নগ্ন অবস্থায় ওই দুই তরুনীর দেহ উদ্ধার হয়।
সূত্রে খবর গত প্রায় আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে মণিপুরের বিভিন্ন থানায় ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, অস্ত্র লুঠের একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। সহিংসতায় এখনও পর্যন্ত ১৩০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ঘরছাড়া হাজার হাজার মানুষ। মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় নারী কমিশনও। তবে এত ঘটনার পরেও প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশের ভূমিকা।
এমন অবস্থায় মণিপুরের 'আয়রন লেডি' হিসেবে পরিচিত ইরম শর্মিলার দাবী, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হস্তক্ষেপ করা উচিৎ।
শর্মিলার অভিমত, 'অসম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার বেষ্টিত মণিপুরে সহিংসতার পেছনে রয়েছে বেকারত্ব, মাদক পাচার ও অপব্যবহার। রাজ্য সরকার তার কর্মচারীদের প্রতিমাসে নিয়মিত বেতন দিতে পারে না। তার ওপর, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বেতনের একটি অংশ দিতে হয় রাজ্যের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে। একপক্ষ একপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, কাউকেই শান্তি আলোচনার পক্ষে দেখা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী মণিপুরের বিধায়কদের সাথে দেখা করে সমস্যার সমাধান করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আমি অবিলম্বে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।' তবে প্রয়োজনে তিনিও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে পারেন বলে জানান মণিপুর থেকে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আফস্পা প্রত্যাহারের দাবীতে প্রায় ১৬ বছর ধরে অনশন করা শর্মিলা।
মহিলাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে চিঠি লিখেছেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। সেইসাথে মণিপুরে শান্তি ফেরাতে তার হস্তক্ষেপ চেয়ে আর্জিও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। চিঠিতে তিনি লেখেন, "মণিপুরে হাড় হিম করা ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন। এখনও পর্যন্ত কয়েক শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, প্রচুর সম্পত্তি নষ্ট করা হয়েছে, যৌন নির্যাতন চলেছে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আমাদের শেষ আশা, ভরসা ও অনুপ্রেরণা আপনি। যিনি মণিপুর তথা গোটা ভারতবাসীর কাছে আশার আলো দেখাতে পারেন।"
মণিপুরের এমন ঘটনায় উদ্বেগে রয়েছেন কলকাতার বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবে খেলা রাজ্যের বেশ কিছু তারকা ফুটবলাররা। রীতিমত উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। জানা গেছে, জাতীয় ফুটবল দলের তারকা ফুটবলার চিঙ্গলেন সানার বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়েছে। কলকাতার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কয়েকজন ফুটবলার তাদের গোটা পরিবার নিয়ে মণিপুর থেকে কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আপাতত রাজারহাট, সিআইডি রোডের ফ্ল্যাটেই সেই সমস্ত ফুটবলার ও তাদের পরিবারের সদস্যের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এদিকে মণিপুর রাজ্যের সহিংসতার ঘটনার প্রভাব পড়ল প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরামেও। তার কারণ মিজোরামে বসবাসকারী মেইতি সম্প্রদায়ের মানুষদের রাজ্য ছাড়ার ডাক দিয়েছে সেখানকার প্রাক্তন জঙ্গি সদস্যদের সংগঠন 'পামরা' (পিস অ্যাকর্ড এমএনএফ রিটার্নিজ অ্যাসোসিয়েশন)। এক বিবৃতি প্রকাশ করে মেইতিদের রাজ্য ছাড়ার আর্জি জানিয়ে বলা হয়েছে, দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে ঘোরানোর ঘটনায় মিজো যুবকদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এও বলা হয়েছে ভবিষ্যতে মেইতিদের ওপর কোন অত্যাচারের ঘটনা ঘটলে তারা নিজেরাই ওই ঘটনার জন্য দায়ী থাকবে।
শুক্রবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটির তরফে জানানো হয় 'মিজোরামের পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং মণিপুরে দুষ্কৃতীদের দ্বারা সংঘটিত বর্বর ও জঘন্য কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে মণিপুরের মেইতি জনগণের জন্য মিজোরামে বসবাস করা আর নিরাপদ নয়। মিজোরামের সমস্ত মেইতি জনগণকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই তাদের নিজ রাজ্যে (মণিপুর) চলে যাওয়ার জন্য আবেদন করা হচ্ছে।'
এই বিবৃতির পরই মেইতিদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিজোরাম রাজ্য সরকার। মিজোরামের রাজধানী আইজলে মেইতি জনজাতিদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে মিজোরাম রাজ্য সরকার। নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে সেলেশই এলাকায় অবস্থিত ভেটি কলেজ, তানহারিল এলাকায় অবস্থিত মিজোরাম ইউনিভার্সিটি সহ বেশ কিছু এলাকায় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
পাশাপাশি বিশেষ বিমানে করে মেইতি সম্প্রদায়ের মানুষদের রাজ্যে ফিরিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করছে মণিপুর সরকার। কারণ মণিপুর এবং দক্ষিণ সমের কয়েক হাজার মেইতি সম্প্রদায়ের মানুষ মিজোরামে বসবাস করে আসছেন। যদিও কখন এই ইভাকুয়েশন প্রক্রিয়া চালু হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়।
তবে মণিপুরের ঘটনায় এখনও দেশজুড়ে চলছে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ। দুই নারীকে বিবস্ত্র করে ঘোরানোর ঘটনায় দোষীদের ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর দাবী তুললেন কেন্দ্রীয় ন্যায় বিচার ও ক্ষমতায়ন প্রতিমন্ত্রী রামদাস আতাওয়ালে। তিনি বলেন, "মণিপুরের ঘটনা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সরকারও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। অভিযুক্ত ১১ জনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আমরা চাই দোষীদের ফাঁসির সাজা দেওয়া হোক।"
দোষীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবী তুলেছেন মণিপুরের ক্যাবিনেট মন্ত্রী নেমচা কিপগেন। তিনি বলেন 'একজন মা, বোন এবং মেয়ে হিসেবে ওই ঘটনা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। আমি দোষীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবী জানাচ্ছি।'
No comments:
Post a Comment