নদীপাড়ে উঠেছে কংক্রিটের পিলার। কাঁটাতারের বেড়ায় গতি হারাচ্ছে নদীবাঁক। নদীবুক হয়ে উঠেছে বেপরোয়া লুটের স্বর্গরাজ্য! নদীর বর্ণময় গতিপথ হচ্ছে ক্ষতবিক্ষত। কোপাই আজ বিধ্বস্ত!
যে কোপাইয়ের বৈচিত্রময় গতিপথের প্রতিটি বাঁকের সাথে জড়িয়ে আছে আবেগ। নদীপাড়ের খেটে খাওয়া মানুষের রোজনামচা ওতপ্রোতভাবে আকড়ে আছে কোপাইয়ে বাঁককে। আজ সেই বাঁকেই থাবা বসিয়েছে লোভ। মুনাফা লোভীদের লোলুপ দৃষ্টি। অবলীলায় কোপাইয়ের পাড় হয়ে যাচ্ছে দখল। বেমালুম ঘিরে ফেলা হচ্ছে কংক্রিটের খুঁটি ও কাঁটাতারের বেড়াজালে। উদ্দেশ্য স্রেফ মুনাফা। জমি হাঙরদের নিশানায় কাঁদছে কোপাই। জমি কারবারি, মুনাফা লোভীদের এত বেপোরোয়াপনা পেছনে নিশ্চিতভাবেই রয়েছে শাসকদলের তাবড় নেতাদের মদত। জানেন এলাকাবাসী। বলছেনও তারা।
কোপাইয়ের পাড় মানেই রীতি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও নৈস্বর্গিক শোভার এক অনবদ্য মেলবন্ধন।
এলাকার আদিবাসী মহল্লা সহ সব মানুষের কাছে প্রানের চেয়েও প্রিয় কোপাই। তাই সেই কোপাইয়ের বুকে জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ব তারা মেনে নিতে পারছেন না। আছে চোখ রাঙানি। আছে শাসানি। সঙ্গে আছে কোপাইয়ে পাড় চুরি আটকানোর জেদও। প্রমান মিলেছে কোপাইয়ের পাড়েই। গত কয়েক বছর ধরে গোয়ালপাড়ার, পিয়ারসন সেতু সংলগ্ন এলাকায় কোপাই নদীর দুই পাড়ে, এমনকী নদীবক্ষেও একের পর এক গজিয়ে উঠছে কংক্রিটের পিলার। সরকারি সম্পদ রাতারাতি ভোল বদলে হয়ে যাচ্ছে বেসরকারি সম্পত্তি। কারন পর্যটকদের এখন অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে শান্তিনিকেতন, কোপাই। বাড়ছে জমির চাহিদা। তাই হাত পড়েছে নদীর বুকে। নদীর পাড়েই অবলীলায় খাড়া হচ্ছে রিসর্ট, বাংলো, ক্যাফেটেরিয়া। নদীর বুক থেকে মাটি তুলে তৈরি হচ্ছে ইঁট।
বারংবার সরব হয়েছে এলাকার আদিবাসী মানুষেরা। তাদের একটাই আর্তি রক্ষা করো কোপাই। এলাকার বাসিন্দা শ্যাম বেসরা, সোনা মূর্মূদের কথায়, ‘‘কোপাইয়ের ঐতিহ্য আছে। কোপাইয়ের সাথে জড়িয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। সেই কোপাইয়ের পাড় এভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে। নদীপাড়ে পিলার পুঁতে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে নেওয়া হচ্ছে নদীপাড়।’’ এলাকার এক বাসিন্দা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, ‘‘শাসকদলের নেতারাই তো মদতদাতা। মদতের পেছনে স্বার্থ কি সবাই জানে। প্রশাসনের কাছে, পঞ্চায়েতে কতবার জানিয়েছি। কে কার কথা শোনে।’’
তবে শত চোখরাঙানীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও আদিবাসীদের হয়েছেন মুখর। ক্ষোভ জানাচ্ছেন প্রকাশ্যেই। বেগতিক বুঝেছে প্রশাসন। নড়েচড়ে বসেছে এবার। বোলপুরের মহকুমাশাসক মানস হালদার এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘নদীর পাড় ও নদীবক্ষ বিক্রি করা যায় না ৷ বিষয়টি সরজমিনে দেখার জন্য বিএলআরও’কে নির্দেশ দিয়েছি ৷’’ এব্যাপারে সিপিআই(এম) নেতা গৌতম ঘোষ বলেন, ‘‘ভয়ঙ্কর ব্যাপার ৷ গত কয়েক বছর ধরে তৃণমূল সরকার দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে। রিসোর্ট, হোটেল বানানোর জন্য প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে ৷’’
এলাকার আদিবাসী সহ সব মহলের ক্ষোভের কথা চাউর হতেই বুধবার কোপাই পাড় পরিদর্শন করেছে ভূমি দপ্তরের আধিকারিকরা। করেছেন মাপজোক। কংক্রিটের পিলার, কাঁটাতারের বেড়া স্বচক্ষে দেখেছেন তার। বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের ভূমি আধিকারীক সঞ্চয় রায় জানিয়েছেন, ‘আমরা এলাকা পরিদর্শন করেছি। ম্যাপ, রেকর্ড নিয়ে মাপঝোক শুরু হয়েছে। সম্পূর্ন করতে হতে কিছুটা সময় লাগবে। যদি বেআইনীভাবে দখল হওয়া প্রমানীত হয় তাহলে দৃষ্টান্তমূলক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
এলাকার মানুষ ক্ষোভের আঁচে প্রশাসনের কর্তারা নড়েছেন ঠিকই। কিন্তু আদৌ কি তাতে শেষ রক্ষা হবে? বাঁচবে কোপাইয়ের পাড়? কোপাই কি ফিরে পাবে তার ঐতিহ্য? কোপাইয়ের প্রতিটা বাঁকে যেন ধ্বণিত হচ্ছে এই প্রশ্নই।
No comments:
Post a Comment